“একজন তরুণ, যিনি ডিগ্রি শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়েছেন এবং এখন ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করছেন, তার অনুপ্রেরণামূলক যাত্রা সম্পর্কে জানুন। পড়াশোনা ও কর্মজীবনের সাফল্যের মিশেলে তৈরি করেছেন একটি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তার গল্প আপনাকে নতুন সুযোগের প্রতি অনুপ্রাণিত করবে এবং ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিবে।”
বিজ্ঞাপন বিহীন সংবাদ পড়তে আমাদের ফেসবুক পেজ ফলো দিন, একদেশ নিউজ খবর পেতে গুগল নিউজ ও ইউটিউব চ্যানেল ফলো করুন
তখন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)-এর প্রতিষ্ঠা খুব বেশি দিনের নয়। তেমন একটা পরিচিতিও তৈরি হয়নি, উপরন্তু তথাকথিত প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল না। এমতাবস্থায় মাসুদ ইফতেখার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করার আগেই একটি চাকরির প্রস্তাব হাতে পান। বর্তমানে তিনি সুইডেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেলিকম সংস্থা এরিকসনের ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলের ‘কি অ্যাকাউন্ট কন্ট্রোলার’ পদে কর্মরত। এর আগে প্রায় পাঁচ বছর ধরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। এই কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব নিজেকে কীভাবে আজকের অবস্থানে উন্নীত করেছেন?
শিক্ষকের নির্দেশনায় পথচলা:
২০০৭ সালে ইউআইইউর ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে ফিন্যান্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন মাসুদ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কোন স্মৃতি বিশেষভাবে মনে পড়ে, এই প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বলেন, ‘শিক্ষকদের সান্নিধ্যে কাটানো সময়গুলো আমার কাছে অমূল্য। সম্ভবত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকায় আমরা তাঁদের কাছ থেকে এতটা নিবিড় মনোযোগ ও সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁরা আমাকে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি জীবনে সফল হওয়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এমনকি আমি ইংরেজি বিভাগের টিএ (শিক্ষকের সহকারী) হিসেবেও কাজ করেছি।’
আরোও পড়ুন
আন্তর্জাতিক ইংরেজি সংবাদ শিরোনাম [বাংলাতে অনুবাদ করা হয়েছে]
ইউআইইউর তৎকালীন ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে প্রায় বারো ঘণ্টা সময় কাটাতেন মাসুদ। তবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে লেখাপড়ার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ছিল বেশি। শিক্ষকদের উৎসাহমূলক কথা তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করত। মাসুদ স্মরণ করেন, ‘আমাদের তৎকালীন ডিন হাবীব স্যার প্রায়ই বলতেন, “মানুষ যা করেছে, মানুষ তা করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর একজন শিক্ষার্থী যদি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি পেতে পারে, তুমিও পারবে। বড় স্বপ্নকে সামনে রেখে আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হবে।”’ তাঁর বিশ্বাস, এই মূল্যবান পরামর্শ এবং উপদেশগুলোই আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে তাঁকে সাহায্য করেছে।
চাকরির পাশাপাশি মাসুদ ইফতেখার নবীন উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকেন। প্রায় দুই বছর ধরে তিনি সিলিকন ভ্যালির ‘ফাউন্ডার ইনস্টিটিউট’ ও ‘স্টার্টআপ ওয়ার্ল্ড কাপ’-এর সাথে যুক্ত আছেন। তিনি অর্থনীতি বিষয়ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের উপায় বাতলে দেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আয়োজিত সেশনে মেন্টর হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তবে আক্ষেপের সাথে তিনি জানান, এখনো পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক সেশনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেখতে পাননি। তিনি বলেন, ‘হয়তো তাঁরা অন্য কোথাও কর্মরত আছেন এবং ভালো করছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে তাঁদের দেখা হয়নি। তবে বাংলাদেশের কোনো সংস্থা যদি আমাদের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ বা সহযোগিতা চায়, আমরা সবসময় তাদের পাশে থাকতে প্রস্তুত।’
মাসুদ ইফতেখার গত এক বছর ধরে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও যাত্রা শুরু করেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় নবায়নযোগ্য সৌরশক্তিতে তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়াও, তিনি সেই দেশে কৃষিকাজের সাথেও জড়িত।
নিজেকে প্রমাণ করার সংগ্রাম:
প্রায় আঠারো বছরের কর্মজীবনে মাসুদ বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করেছেন। তবে তাঁর কর্মজীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘যখন আমি স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র, তখনই আমার চাকরি হয়। কিন্তু অফিসে যোগ দিয়ে দেখি, আমার প্রায় ৭০ শতাংশ সহকর্মী আইবিএ থেকে এসেছেন। এরপরের উল্লেখযোগ্য অংশ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তখন তেমন পরিচিত ছিল না। আমি যখন বলতাম ইউআইইউ, ধানমন্ডি, তখন অনেকেই চিনতেন না। আমাকে প্রতিনিয়ত নিজের কাজের মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে। প্রায় ছয় মাস থেকে এক বছর পর মানুষ আমার শিক্ষাগত পটভূমি নিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ করে। এরপর তারা আমার কাজ দিয়েই আমাকে মূল্যায়ন করত।’
আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর পেছনে একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই মাসুদ চিন্তা করতেন, পাঁচ বছর পর তিনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান। ২০১০ সালে যদি সহকারী ব্যবস্থাপক হতে চান, তাহলে ২০০৭ সালেই চাকরিতে যোগদান করতে হবে—এই ধরনের হিসাব তিনি তখন থেকেই করতেন। শিক্ষক ও মেন্টরদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে পরিকল্পনা করে এগিয়েছেন। ভবিষ্যতের লক্ষ্য স্থির রাখার জন্য তিনি এক্সেলে বাৎসরিক পরিকল্পনা লিখে রাখতেন।
প্রথম চাকরির সাক্ষাৎকারে বসার সময় তাঁর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। শুধুমাত্র ভালো সিজিপিএ এবং বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ছিল তাঁর সম্বল। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে মাসুদ ইফতেখার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার অনুরোধ বা পরামর্শ হলো, ভালোভাবে পড়াশোনা করে নিজের বিষয়ে দক্ষ হও। অনেকে মনে করে, শুধু ইংরেজি জানলেই স্মার্ট হওয়া যায়। কিন্তু বিদেশে সবাই ইংরেজি জানে, সবাই তো সফল নয়। তাই নিজের বিষয়ের ওপর গভীর জ্ঞান রাখার পাশাপাশি কোম্পানিগুলো কীভাবে সেই জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করছে, তা জানতে হবে। যেকোনো কাজের চ্যালেঞ্জ ও সুবিধা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। নতুন কোনো ধারণা তৈরি করতে পারলে তা অত্যন্ত মূল্যবান।’
মাসুদ ‘ব্যর্থ’ শব্দটিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তাঁর মতে, ‘যদি প্ল্যান এ কাজ না করে, তবে প্ল্যান বি তো আছেই। একটা উপায় ব্যর্থ হলে, অন্য কোনো উপায় নিশ্চয়ই সফল হবে। সাফল্যের চেয়ে শতভাগ চেষ্টা করার মানসিকতাই বরং বেশি জরুরি।’