১৯৭১ সালের মে মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন প্রস্তুতির দলিল

১৯৭১ সালের মে মাস ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির এক গৌরবময় অধ্যায়। দামাল ছেলেরা তখন দেশমাতৃকার জন্য জীবনপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গোপনে চলছিল প্রশিক্ষণ, সংগঠন ও পরিকল্পনা। এই সময়কালই স্বাধীনতা অর্জনের পথে বীরযোদ্ধাদের দৃঢ় সংকল্প ও সাহসিকতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।


মে মাসের শুরুতে স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা দৃশ্যপট

মে মাসের প্রথম দিন ব্রিটিশ এমপি ব্রুস ডগলাস-ম্যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। এছাড়া তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করার আবেদনপত্রও পাঠান। একই দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘প্রাভদা’ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবিক সংকটের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে সমালোচনা করে উল্লেখ করে, এর প্রভাব শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, গোটা এশিয়া এবং বিশ্বেও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

ইংল্যান্ডের উরস্টার শহরে প্রায় ছয়শ প্রবাসী বাঙালি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম ম্যাচের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভকারীরা নানা ধরণের প্ল্যাকার্ডে দাবি উপস্থাপন করে। অন্যদিকে, দেশের অভ্যন্তরেও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া কিছু ব্যক্তির বক্তব্য উঠে আসে, যেমন ময়মনসিংহের প্রাদেশিক সদস্য সৈয়দ বদরুজ্জামান, যিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।

২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করলেও ৫ মে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে তিনি জীবিত ও সুস্থ আছেন। এই খবর বাঙালি জাতির মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহস জোগায়।

পাকিস্তানি সেনারা সারাদেশে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চালায়, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটির সদস্যরা। তারা মূলত বাঙালিদের নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করেছিল। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বেশি নির্যাতন সংঘটিত হয়। পরে ১৬ মে শান্তি কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘শান্তি ও সংহতি কমিটি’ করা হয় এবং তার সদস্যদের তালিকা ঘোষণা করা হয়।

মে মাসে পাকিস্তানি সেনাদের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটে খুলনার ডুমুরিয়া থানার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগর এলাকায়, যেখানে প্রায় ১২ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। এছাড়া নাটোরের লালপুরে ৪৬ জন কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা ‘শহীদ সাগর’ নামে পরিচিত পুকুরের পুকুরপাড়ে সংঘটিত হয়।

এ সময় বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ পক্ষের জনমত গড়ে ওঠে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ভারতীয় শরণার্থীদের পাশে থাকার কথা বলেন এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানোর আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রেও পাকিস্তানে সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে। মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি উদ্বাস্তু সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপের আবেদন জানান।

মে মাসেই ভারতে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, যেমন বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে ও নৌ-কমান্ডোদের হাতিমারা ক্যাম্পে। এই প্রশিক্ষণে দেশপ্রেমিক তরুণরা কঠোর শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেন স্বাধীনতার জন্য।

১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি সেনারা ভয়াবহ গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে বাঙালির ওপর নিষ্ঠুরতা চালায়, তবে বাঙালি যুবকদের শক্তি ও সাহস তাদেরকে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version