রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশের জন্য ইন্টারপোলে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। আর্থিক দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পলাতক এই ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে এখনও তালিকা প্রকাশ হয়নি, তবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিজ্ঞাপন বিহীন সংবাদ পড়তে আমাদের ফেসবুক পেজ ফলো দিন, একদেশ নিউজ খবর পেতে গুগল নিউজ ও ইউটিউব চ্যানেল ফলো করুন

ইন্টারপোলে রেড নোটিশের আবেদন:
বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) শেখ হাসিনাসহ মোট ১২ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করেছে। গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়েছে
- শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী
- ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী
- আসাদুজ্জামান খান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
- আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী
- হাছান মাহমুদ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
- জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী
- মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী
- শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
- তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা
- নসরুল হামিদ, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী
- মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
- বেনজীর আহমেদ, সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি)
জুলাইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। বিভিন্ন দেশে পলাতক এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি ধাপে ইন্টারপোলের কাছে এই অনুরোধ পাঠানো হয়েছে।
আবেদনের প্রক্রিয়া ও অভিযোগ:
যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাক্তন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, প্রাক্তন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রাক্তন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রাক্তন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, প্রাক্তন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং প্রাক্তন আইজিপি বেনজীর আহমেদ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করা হয়। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, আদালত, সরকারি আইনজীবী অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ জারির জন্য অনুরোধ পাঠায়।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের মধ্যে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ও বেনজীর আহমেদ ছাড়া অন্য ১০ জনের বিরুদ্ধে ১০ এপ্রিল ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ পাঠানো হয়। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান সরকারি আইনজীবীর কার্যালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে নথি ও চিঠি পাঠানো হয়।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান সরকারি আইনজীবীর কার্যালয় থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের কাছে রেড অ্যালার্ট জারির অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
এনসিবি যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালত থেকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ জারির আবেদনের পাশাপাশি, ভারতসহ যেসব দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে, সেই চুক্তির আওতায় বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে, বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখানেই অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী, তাকে ফেরত আনার জন্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।
তবে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় তার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে।
ইন্টারপোলের ভূমিকা ও বর্তমান অবস্থা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জুলাইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলা রয়েছে। এই মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও অভিযুক্ত। এছাড়া ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় একটি এবং বিগত সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় আরেকটি মামলা রয়েছে।
প্রধান সরকারি আইনজীবীসহ একাধিক সরকারি আইনজীবী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামীকাল রোববার এই মামলায় ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।
বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি ও চ্যালেঞ্জ
ইন্টারপোল বিদেশে পলাতক আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে সহযোগিতা করে। অন্যদিকে, বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট দেশ ইন্টারপোলকে জানায়। যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করা হয়েছে, সেগুলো বর্তমানে ইন্টারপোলে প্রক্রিয়ধীন রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) ইনামুল হক জানিয়েছেন, ইন্টারপোলের সদস্যভুক্ত দেশ এখন ১৯৬টি। অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য যাচাই-বাছাই এবং আদান-প্রদানে এই ১৯৬টি দেশের সাথে বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবির নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কোনো অপরাধী দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অবস্থান করলে, তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ রেড নোটিশ জারির অনুরোধ জানায়।
ইন্টারপোল যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে, তাদের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ৬ হাজার ৫৮৩ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ দেখা যায়, যার মধ্যে ৬২ জন বাংলাদেশি। তবে রেড নোটিশ জারির জন্য সম্প্রতি অনুরোধ করা ১২ জনের নাম তালিকায় নেই।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিশ জারির তালিকায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দুবাইয়ে পলাতক রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান, শীর্ষ সন্ত্রাসী ফেরদৌস জাহাঙ্গীর ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ, শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, প্রাক্তন সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি প্রমুখের নাম রয়েছে। তালিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের নাম ও ছবিও রয়েছে।
নতুন করে যে ১২ জনের জন্য রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করা হয়েছে, তাদের নাম ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে না থাকার কারণ সম্পর্কে সরকার ও পুলিশের উচ্চপর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছে প্রথম আলো। তারা জানান, অনুরোধের পর রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে রাজনৈতিক ঘটনাগুলোতে ইন্টারপোল নোটিশ জারির ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করে। বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাসহ অন্যদের ঘটনাকে রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। এ কারণে নোটিশ জারির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। তবে বেনজীর আহমেদের ঘটনাটি আর্থিক দুর্নীতি বা অপরাধ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান চলাকালে গত বছরের ৪ মে তিনি সপরিবারে দেশ ছাড়েন। তিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
প্রাক্তন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১০ জন গত ৫ আগস্টের আগে-পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর মধ্যে প্রাক্তন মেয়র তাপস ৩ আগস্ট দেশ ছাড়েন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জুলাইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কা রয়েছে। চ্যালেঞ্জ হলো, পলাতকদের কেউ কেউ অন্য দেশের নাগরিক অথবা অন্য দেশে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি রয়েছে। আর আশঙ্কা হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের মধ্যে যারা বিদেশে পলাতক, তারা বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে বা লবিস্ট নিয়োগ করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এনসিবির সূত্রগুলো জানায়, রেড নোটিশ সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নয়। তবে এই নোটিশ জারি হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় বিমানবন্দরে বা ইমিগ্রেশনে আটক হতে পারেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হয়ে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে পারেন।
পরবর্তী পদক্ষেপ
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) ইনামুল হক প্রথম আলোকে জানান, বিদেশে পলাতক আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে ইন্টারপোল সহযোগিতা করে। অন্যদিকে, বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট দেশ ইন্টারপোলকে জানায়। যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুরোধ করা হয়েছে, সেগুলো বর্তমানে ইন্টারপোলে প্রক্রিয়ধীন রয়েছে।