রেললাইনে পাওয়া গেল এক বিজিবি সদস্যের নিথর দেহ, যা ঘিরে তৈরি হয়েছে চরম রহস্য ও বিষাদের ছায়া। সাহসী এই সদস্যের নীরব বিদায় সমাজে ফেলে গেছে বহু প্রশ্ন। এই ঘটনা শুধু একটি মৃত্যু নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের এক বেদনাবিধুর অধ্যায়। বিস্তারিত জানতে পড়ুন সম্পূর্ণ প্রতিবেদন।
রোদ তখন পশ্চিমে ঢলে পড়ছিল নিঃশব্দে। কুড়িগ্রামের আকাশে যেন এক চাপা নিস্তব্ধতা, যেন প্রকৃতি নিজেই প্রস্তুত হচ্ছিল কোনো অনিবার্য ঘটনার সাক্ষী হতে। উলিপুর উপজেলার গাবেরতল—ধানখেতের প্রান্ত ঘেঁষা একটি রেললাইন, যেখানে প্রতিদিনের জীবন চলে ট্রেনের ছন্দে। কিন্তু ২০২৫ সালের ১ জুনের এক বিকেলে, এই ছন্দ থেমে গেল একজন মানুষের জীবনের শেষ লগ্নে।
মোস্তাফিজার রহমান মজনু, বয়স ৬৫, পেশায় সাবেক বিজিবি সদস্য। দেশের সীমান্তে বছরের পর বছর সেবা দেওয়া এই মানুষটি জীবনের শেষ মুহূর্ত কাটালেন রেললাইনের পাশে বসে, হাতে একটি প্রেসক্রিপশন ধরা। কী ভাবনা ছিল তাঁর চোখে—বিষাদ, ক্লান্তি, না কোনো অমোঘ সিদ্ধান্ত? তা হয়তো শুধু জানে সেই বাতাস, যেটি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে চলে গেল অনন্তের দিকে।
সবকিছু ঘটল হঠাৎই। পার্বতীপুরগামী একটি লোকাল ট্রেন এসে পড়ল—কোনো হুঁশিয়ারি নেই, কোনো শব্দ নেই। এক মুহূর্তেই সব শেষ। ট্রেন চলে গেল, আর পড়ে রইল ছিন্নভিন্ন একটি দেহ—জীবনের সব গল্প থেমে গেল একটি অচিহ্নিত সময়রেখায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বললেন, তিনি কিছু সময় আগে থেকেই লাইনের পাশে বসে ছিলেন, প্রেসক্রিপশনের কাগজটি হাতে তুলে নিতে দেখা গেছে।
কেউ বুঝতে পারেনি, সেটিই ছিল জীবনের শেষ অধ্যায়—এক সাহসী জীবনের শেষ প্রহর।
খবর ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই। গ্রামবাসীরা ছুটে আসেন, কেউ কাঁদেন, কেউ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এতোদিন যাঁকে বাজারে, মসজিদে দেখা যেত, তিনি আজ আর নেই। যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা নেমে আসে মাদারটারি গ্রামের আকাশে।
মোস্তাফিজার রহমান ছিলেন ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা, মৃত আব্দুল জলিলের পুত্র। জীবনের প্রতিটি ধাপ তিনি পেরিয়েছেন কর্তব্যের কঠোরতায়। কিন্তু শেষ সময়ে এসে তিনি যেন একা হয়ে পড়েছিলেন—চিকিৎসা, সেবা কিংবা সাহচর্যের অভাবে।
স্থানীয় পুলিশ নিয়ম অনুযায়ী মরদেহ উদ্ধার করে, কিছু সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। প্রশাসন জানায় তদন্ত হবে, কিন্তু গ্রামের মানুষ প্রশ্ন তোলে—এই মৃত্যুর দায় আসলে কাদের? সময়ের? সমাজের? না কি আমাদের সবার?
আজ রেললাইনের পাশে বাতাসে দুলতে থাকা ঘাসগুলো যেন জানে, একজন যোদ্ধা নীরবে, নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা করলেন। তাঁর মৃত্যু কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, এটি সমাজের নিষ্ক্রিয়তার আর্তনাদ।